Man's Collectons
ইসলামী শরীয়তের দৃষ্টিতে হালাল ও বৈধ ব্যবসা পদ্ধতি
মহান আল্লাহপাক মানুষকে একমাত্র তাঁর ইবাদতের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। শুধু নামাজ রোজা, হজ্ব ও যাকাত আদায় করার নাম ইবাদত নয়: বরং আল্লাহ ও তার রাসূলের হুকুম অনুসারে যখন যা করা হবে তাই ইবাদত রুপে গণ্য হবে। ব্যবসা বাণিজ্য হচ্ছে হালাল উপার্জনের একটি অনন্য পন্থা।
যারা আল্লাহর বিধান অনুসারে ব্যবসা করে তারা আল্লাহর নিকট অত্যন্ত মর্যাদাবান। যারা আল্লাহর অন্যান্য বিধান পালন করতঃ সৎভাবে ব্যবসা করে তাদের ভূয়সী প্রশংসা করে মহান আল্লাহপাক ইরশাদ করেন “সেই সকল লোক যাদেরকে ব্যবসা বাণিজ্য এবং ক্রয়-বিক্রয় আল্লাহর স্মরণ হতে এবং সালাত কায়েম ও যাকাত প্রদান হতে বিরত রাখে না, তারা ভয় করে সেই দিনকে যেই দিন তাদের অন্তর ও দৃষ্টি বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে”। (সূরা নূর: আয়াত-৩৭)।
যে সকল সৎ ব্যবসায়ী সঠিকভাবে মেপে দেয়, ব্যবসার ক্ষেত্রে কোন প্রকার মিথ্যার আশ্রয় নেয় না তাদের সু মহান মর্যাদা ও শুভ পরিণাম ঘোষণা করে আল্লাহপাক ইরশাদ করেন- “মেপে দিবার সময় পূর্ণভাবে দিবে এবং ওজন করবে সঠিক দাড়িপাল্লায়, ইহাই উত্তম এবং পরিণামে উৎকৃষ্ট” (সূরা বনি ইসরাঈল: আয়াত-৩৫)।
অবৈধ ব্যবসা-বাণিজ্যের আকণ্ঠে নিমজ্জিত আমাদের সমাজ। অবৈধ ব্যবসার ছড়াছড়ি আজ সর্বত্র। অবৈধ ব্যবসার তান্ডবে আজ লুকিয়ে যাচ্ছে হালাল ব্যবসা। ব্যবসার নাম নিয়ে সুদের লেনদেন করছেন আমাদের সমাজের অনেকে। এদের পরিণাম অত্যন্ত করুণ। এদের সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হচ্ছে- “তাদের অনেককেই তুমি দেখবে পাপে সীমালংঘনে ও অবৈধ ভক্ষণে (সুদ, ঘুষ-দুর্নীতিতে)” তৎপর: তারা যা করে নিশ্চয়ই তা নিকৃষ্ট” (সূরা মায়িদা: আয়াত-৬২)।
ব্যবসা তো হচ্ছে সেটা যাতে টাকা বিনিয়োগ করা হয়, চিন্তা ফিকির ও পরিশ্রম করা হয় এবং লাভ ক্ষতি উভয়টাকে সর্বান্তকরণে মেনে নেয়া হয়।
চিন্তাফিকির নেই, পরিশ্রম নেই, কোন প্রকার ক্ষতিকে মেনে নেয়া হয় না- সেটাকে কোন বিবেকে ব্যবসা বলা
সুদকে ইসলামে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। হযরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণিত হাদীসে রাসূল সা. ইরশাদ করেন- “সুদের গুনাহের সত্তরভাগের ক্ষুদ্রতম ভাগ এই পরিমাণ যে, কোন ব্যক্তির নিজের মাকে বিয়ে করে” (মিশকাত শরীফ: পৃষ্ঠা-২৪৬)। হযরত জাবের রা. বর্ণিত হাদীসে আছে- সুদ দাতা ও গ্রহীতা উভয়ের উপরই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের লা’নত। (মুসলিম)।
ইসলামে হালাল ব্যবসার গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যবসা করার সময় ক্রেতার প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন করলে ব্যবসায়ীর প্রতি আল্লাহ অত্যন্ত খুশী হন।
ইসলামে ব্যবসার মূলনীতিসমূহঃ
ইসলাম মানুষকে কোনো ক্ষেত্রেই বল্গাহীন স্বাধীনতা দেয় নি। সব ক্ষেত্রেই রয়েছে নির্দিষ্ট নীতিমালা। আয়-উপার্জন ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম ঘটেনি। এ ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে ইসলামের দু’টি মূলনীতি রয়েছে।
এক- ব্যবসায়িক পণ্য, উপাদান ও কায়কারবারগুলো বৈধ হতে হবে। অবৈধ পণ্যের ব্যবসা ও অবৈধ কায়কারবারকে ইসলাম বৈধতা দেয় না। যেমন, মদ, জুয়া, সুদ, ঘুষ ইত্যাদির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত হওয়া ইসলামে অনুমোদন নেই। কারণ, এসব বিষয়কে ইসলামে মৌলিকভাবেই হারাম ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং আপনার ব্যবসার সাথে এসবের সংমিশ্রণ আপনার ব্যবসাকে কলুষিত করে।
দুই- ব্যবসা-বাণিজ্য সকল অবস্থায় বৈধ পন্থায় হতে হবে। অর্থাৎ সেখানে কোনো ধরনের ধোঁকাবাজি, ভেজাল ও ফাঁক-ফোকর থাকতে পারবে না। কোনো ধরনের মিথ্যার আশ্রয় থাকতে পারবে না। এ বিষয়ে ইসলামের কয়েকটি দৃষ্টিভঙ্গি আমরা নিম্নে আলোচনা করছি-
১. ব্যবসায় কারো ক্ষতি করা যাবে না:
ব্যবসা দ্বারা মানুষের উপকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। কারো ক্ষতি যেন না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সিদ্ধান্ত দেন যে,
«أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، قَضَى أَنْ لَا ضَرَرَ وَلَا ضِرَارَ».
“নিজে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং অন্যের ক্ষতি করা কোনোটিই উচিত নয়”।[1]
ব্যবসা করে গ্রাহকের কাছ থেকে আমরা শুধু লাভ করছি তা নয়; বরং আমরা তাদের জিনিস ও সেবা প্রদান করছি। যদি আমরা যৌক্তিক লাভ করে থাকি এবং মনোপলি না করি তবে সমাজের জন্য এটি একটি বড় সহায়তা। ভালো জিনিস যৌক্তিক দামে প্রদান করায় সমাজের মানুষ সন্তুষ্ট হবে, তাতে আল্লাহ তা‘আলাও আমাদের ওপর সন্তুষ্ট হবেন। যখন ব্যবসায়ী ও গ্রাহক উভয় পক্ষ অনুভব করবে আমরা উপকৃত হয়েছি তখন সেখানে একটি হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হবে। ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা বন্ধ হয়ে যাবে। যা একটি সুগঠিত সমাজের জন্য প্রয়োজন। এতে উভয় পক্ষই পারস্পরিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সাওয়াব পাবেন। ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২৩৪১
২. ধোঁকা, প্রতারণা ও ফাঁকিবাজি করা যাবে না:
এ ধরনের অপকর্ম ইসলামে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত। মন্দ জিনিস ভালো বলে চালিয়ে দেওয়া, ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশ্রণ ঘটিয়ে ধোঁকা দেওয়া ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
«أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيهَا، فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلًا فَقَالَ: «مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ؟» قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: «أَفَلَا جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَيْ يَرَاهُ النَّاسُ، مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّي».
“একদিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বাজারে গিয়ে একজন খাদ্য বিক্রেতার পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন, তিনি খাদ্যের ভিতরে হাত প্রবেশ করে দেখলেন ভিতরের খাদ্যগুলো ভিজা বা নিম্নমান। এ অবস্থা দেখে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে খাবারের পন্যের মালিক এটা কী? লোকটি বলল, হে আল্লাহর রাসূল, এতে বৃষ্টি পড়েছিল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি সেটাকে খাবারের উপরে রাখলে না কেন; যাতে লোকেরা দেখতে পেত? “যে ধোঁকা দেয় সে আমার উম্মত নয়”। সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০২
৩. মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া যাবে না:
মিথ্যা অবশ্যই একটি নিন্দনীয় ও বড় ধরনের অপরাধ। ব্যবসার সাথে মিথ্যার সংমিশ্রণ আরও বেশি মারাত্মক ও ক্ষতিকর। কোনো মুসলিম সত্যের সঙ্গে মিথ্যার সংমিশ্রণ করতে পারে না। সত্যকে গোপন করতে পারে না। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَلَا تَلۡبِسُواْ ٱلۡحَقَّ بِٱلۡبَٰطِلِ وَتَكۡتُمُواْ ٱلۡحَقَّ وَأَنتُمۡ تَعۡلَمُونَ ٤٢﴾ [البقرة: ٤٢]
“তোমরা সত্যের সঙ্গে অসত্যের মিশ্রণ ঘটাবে না। জেনেশুনে সত্য গোপন করো না”। একজন মুমিনের দোষ-ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক, যা মেনে নেওয়া যায়; কিন্তু একজন মুমিনের মধ্যে মিথ্যা ও খিয়ানতের দোষ থাকাকে কোনোক্রমেই মেনে নেওয়া যায় না। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাসা করা হলো,
«أيكون المؤمن جبانًا؟ قال: نعم. قيل: أيكون بخيلاً؟ قال: نعم. قيل: أيكون كذابًا؟ قال: لا».
“একজন মুমিন দুর্বল হওয়া কি স্বাভাবিক? তিনি বললেন, হ্যাঁ- হতে পারে। আবারও জিজ্ঞাসা করা হলো, মুমিন কি কৃপণ হতে পারে? বললেন, হ্যাঁ। তারপর জিজ্ঞাসা করা হলো, একজন মুমিন মিথ্যুক হতে পারে? বললেন, “না”।[2]
হাদীসে একজন মুমিনের অন্যান্য দুর্বলতা বা দোষের কথা স্বাভাবিক বলা হলেও মিথ্যাকে স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়া হয় নি।
এ কারণেই তুমি দেখতে পাবে, যে ব্যবসায়ী সত্যবাদী, আমানতদার-মিথ্যা কথা বলে না, খিয়ানত করে না- তার দিকে মানুষ ঝুঁকে পড়ে। তার ব্যবসা দৈনন্দিন উন্নত হতে থাকে। এ জন্যেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«أربع إذا كن فيك فلا عليك مما فات من الدنيا: حفظ أمانة، وصدق حديث، وحسن خليقة، وعفة في طعمة»[3].
“চারটি গুণ যখন তোমার মধ্যে থাকবে, তখন দুনিয়াদারী সব খুঁয়ে গেলেও তোমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। আমানত সংরক্ষণ, কথায় সততা, উত্তম চরিত্র, হালাল খাদ্য”। এ চারটি গুণ এমন, যেগুলো কোনো ব্যবসায়ীর মধ্যে বিদ্যমান থাকলে, অবশ্যই তার ব্যবসার উন্নতি হবে, আল্লাহ তা‘আলা তার ব্যবসা বাণিজ্যে বরকত দেবেন এবং এ ধরনের ব্যবসায়ী মানুষের নিকট প্রিয় ও গ্রহণযোগ্য হবে।
[1] সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ৪২
[2] বাইহাকী শু‘আবুল ঈমান, হাদীস নং ৪৮১২। হাদীসটি সহীহ।
[3] মুসনাদে আহমাদ (৬৬৫২) ও ত্বাবরানী, হাসান সনদে।
৪- ওজনে নিজ স্বার্থরক্ষায় কমবেশি করা যাবে না:
অন্যকে দেওয়ার সময় ওজনে কম দেওয়া আর নেওয়ার সময় বেশি করে নেওয়া জঘন্য অপরাধ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَيۡلٞ لِّلۡمُطَفِّفِينَ ١ ٱلَّذِينَ إِذَا ٱكۡتَالُواْ عَلَى ٱلنَّاسِ يَسۡتَوۡفُونَ ٢ وَإِذَا كَالُوهُمۡ أَو وَّزَنُوهُمۡ يُخۡسِرُونَ ٣﴾ [المطففين: ١، ٣]
“ধ্বংস যারা পরিমাপে কম দেয় তাদের জন্য। যারা লোকদের কাছ থেকে মেপে নেয়ার সময় পূর্ণমাত্রায় গ্রহণ করে। আর যখন তাদেরকে মেপে দেয় অথবা ওজন করে দেয় তখন কম দেয়”। [সূরা আল-মুতাফফিফীন, আয়াত: ১-৩]
শু‘আইব আলাইহিস সালাম যে নীতি বর্ণনা করেন, কুরআন তা তুলে ধরছেন এভাবে:
وَإِلَىٰ مَدۡيَنَ أَخَاهُمۡ شُعَيۡبٗاۚ قَالَ يَٰقَوۡمِ ٱعۡبُدُواْ ٱللَّهَ مَا لَكُم مِّنۡ إِلَٰهٍ غَيۡرُهُۥۖ وَلَا تَنقُصُواْ ٱلۡمِكۡيَالَ وَٱلۡمِيزَانَۖ ٨٤﴾ [هود: ٨٤]
“হে আমার কাওম! আল্লাহর ইবাদাত কর, তিনি ছাড়া তোমাদের কোনো মা‘বুদ নাই। আর পরিমাপে ও ওজনে কম দিও না”। [সূরা সূরা হূদ, আয়াত: ৮৪]
وَيَٰقَوۡمِ أَوۡفُواْ ٱلۡمِكۡيَالَ وَٱلۡمِيزَانَ بِٱلۡقِسۡطِۖ وَلَا تَبۡخَسُواْ ٱلنَّاسَ أَشۡيَآءَهُمۡ وَلَا تَعۡثَوۡاْ فِي ٱلۡأَرۡضِ مُفۡسِدِينَ ٨٥﴾ [هود: ٨٥]
“আর হে আমার জাতি! ন্যায় নিষ্ঠার সাথে ঠিকভাবে পরিমাপ কর ও ওজন দাও এবং লোকদের জিনিসপত্রে কোনোরূপ ক্ষতি করো না”। [সূরা হূদ, আয়াত: ৮৫]
অন্য জায়গায় আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
وَأَوۡفُواْ ٱلۡكَيۡلَ إِذَا كِلۡتُمۡ وَزِنُواْ بِٱلۡقِسۡطَاسِ ٱلۡمُسۡتَقِيمِۚ ذَٰلِكَ خَيۡرٞ وَأَحۡسَنُ تَأۡوِيلٗا ٣٥﴾ [الاسراء: ٣٥]
“মেপে দেওয়ার সময় পূর্ণ মাপে দেবে এবং সঠিক পাল্লায় ওজন করবে। এটি উত্তম, এর পরিণাম শুভ”। [সূরা বনী ঈসরাইল, আয়াত: ৩৫]
আব্দুল্লাহ ইবন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, “...যখন কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা ওজনে বা মাপে কম দেয়, তখন শাস্তিস্বরূপ তাদের খাদ্য-শস্য উৎপাদন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং দুর্ভিক্ষ তাদের গ্রাস করে”।
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৩
[2] আত-তারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস নং ৭৮৫
[3] মুয়াত্তা মালেক, হাদীস নং ৫৩৭০
৫- পণ্য বিক্রির জন্য মিথ্যা শপথ করা যাবে না:
মিথ্যা মানবতাবোধকে লোপ করে, নৈতিক চরিত্রের অবক্ষয় ঘটায়। মিথ্যাবাদীর উপর আল্লাহর অভিশাপ। মিথ্যা বলে বা মিথ্যা শপথ করে পণ্য বিক্রি করার পরিণতি খুবই ভয়াবহ। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«ثَلَاثَةٌ لَا يُكَلِّمُهُمُ اللهُ وَلَا يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلَا يُزَكِّيهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ: الْمَنَّانُ الَّذِي لَا يُعْطِي شَيْئًا إِلَّا مَنَّهُ، وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْفَاجِرِ، وَالْمُسْبِلُ إِزَارَهُ».
“কিয়ামত দিবসে আল্লাহ তিন ব্যক্তির সাথে কোনো ধরনের কথা বলবেন না, তাদের প্রতি ভ্রুক্ষেপ করবেন না, তাদের পবিত্র করবেন না এবং তাদের জন্য রয়েছে বেদনাদায়ক শাস্তি। তাদের একজন- যে তার ব্যবসায়িক পণ্যকে মিথ্যা কসম খেয়ে বিক্রি করে”।[1]
অপর একটি হাদীসে এ দৃষ্টান্ত এভাবে তুলে ধরা হয়েছে-
«رجل حلف على سلعة بعد العصر، لقد أعطي بها كذا، وكذا، فصدقه المشتري وهو كاذب».
“এক ব্যক্তি আসরের পর তার পণ্য সম্পর্কে কসম খেয়ে বলে, তাকে পণ্যটি এত এত মূল্যে দেওয়া হয়েছে। তার কথা ক্রেতা বিশ্বাস করল, অথচ সে মিথ্যুক”। এ ধরনের ব্যবসায়ীর জন্য উল্লিখিত হাদীসে অত্যন্ত কঠিন ও বেদনাদায়ক শাস্তির কথা বর্ণনা করা হয়েছে।
[1] সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ১০৬
[2] আবু দাউদ, হাদীস নং ৩৪৭৪; নাসায়ী, হাদীস নং ৪৪৬২
৬- নিজে ঠকা যাবে না এবং অপরকেও ঠকানো যাবে না:
এক ব্যক্তি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে অভিযোগ করল, যে সে বেচা-কেনাতে প্রতারিত হয় বা ঠকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
«إِذَا أَنْتَ بَايَعْتَ، فَقُلْ: لَا خِلَابَةَ، ثُمَّ أَنْتَ فِي كُلِّ سِلْعَةٍ ابْتَعْتَهَا بِالْخِيَارِ ثَلَاثَ لَيَالٍ».
“যখন তুমি ক্রয়-বিক্রয় করবে, তখন তুমি বলে দিবে যে কোনো প্রতারণা বা ঠকানোর দায়িত্ব আমি নেব না। তোমার জন্য তিনদিন পর্যন্ত পণ্য ফেরত দেওয়ার অধিকার রয়েছে”।[1]
[1] সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৬৯৬৪
৭- ব্যবসার সাথে সুদকে মেশানো যাবে না:
সুদ একটি মারাত্মক অপরাধ। সুদ থেকে অবশ্যই দূরে থাকতে হবে। ব্যবসার নামে কোন প্রকার সুদ চালু করা যাবে না। সুদের পরিণতি সম্পর্কে আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
ٱلَّذِينَ يَأۡكُلُونَ ٱلرِّبَوٰاْ لَا يَقُومُونَ إِلَّا كَمَا يَقُومُ ٱلَّذِي يَتَخَبَّطُهُ ٱلشَّيۡطَٰنُ مِنَ ٱلۡمَسِّۚ ذَٰلِكَ بِأَنَّهُمۡ قَالُوٓاْ إِنَّمَا ٱلۡبَيۡعُ مِثۡلُ ٱلرِّبَوٰاْۗ وَأَحَلَّ ٱللَّهُ ٱلۡبَيۡعَ وَحَرَّمَ ٱلرِّبَوٰاْۚ٢٧٥﴾ [البقرة: ٢٧٥]
“যারা সুদ খায় তারা কিয়ামতের দিন দণ্ডায়মান হবে শয়তানের আসরে মোহাবিষ্টদের মতো। কারণ, তারা বলে ক্রয়-বিক্রয় (ব্যবসা) ওতো সুদের মতো, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৫]
আল্লাহ তা‘আলা আরও বলেন,
يَمۡحَقُ ٱللَّهُ ٱلرِّبَوٰاْ وَيُرۡبِي ٱلصَّدَقَٰتِۗ ٢٧٦﴾ [البقرة: ٢٧٦]
“আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং দান খায়রাতকে বর্ধিত করেন”। [সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ২৭৬]
রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
«مَا أَحَدٌ أَكْثَرَ مِنَ الرِّبَا، إِلَّا كَانَ عَاقِبَةُ أَمْرِهِ إِلَى قِلَّةٍ».
“সুদ যদিও বৃদ্ধি পায় কিন্তু এর শেষ পরিণতি হচ্ছে স্বল্পতা”।[1]
লেনদেন যদি সুদ সংক্রান্ত হয় তবে হাদীসে এসেছে, জাবের ইবন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু বর্ণনা করেন যে,
«لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ» ، وَقَالَ: «هُمْ سَوَاءٌ».
“আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহণকারী, প্রদানকারী, হিসাবকারী এবং সাক্ষী সকলের প্রতি অভিশাপ দিয়েছেন এবং তিনি বলেন তারা সকলেই সমান”।
[1] ইবন মাজাহ, হাদীস নং ২২৭৯
[2] সহীহ মুসলিম নং ১৫৯৮
৮- অনুমান ভিত্তিক ব্যবসা করা হতে বিরত থাকা:
বৃক্ষস্থিত ফলকে বৃক্ষ হতে আহরিত ফলের বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মুযাবানা বলে। বিভিন্ন ধরণের মুযাবানা বর্তমানেও প্রচলিত আছে। ক্ষেতে অকীর্তিত খাদ্য শস্য যথা গম, বুট ইত্যাদিকে শুকনা পরিষ্কার করা খাদ্য যথা, গম, বুট ইত্যাদির বিনিময়ে অনুমান করে বিক্রি করাকে মুহাকালা বলে। সুদের আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এগুলোকেও সুদের অন্তর্ভুক্ত করে দেন।
[1] ইবন কাসীর
৯-অপরের মাল হনন করার চেষ্টা করা যাবে না:
ব্যবসার জটিল মারপ্যাঁচে অন্যের মাল হরণ করা হারাম। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
يَٰٓأَيُّهَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ لَا تَأۡكُلُوٓاْ أَمۡوَٰلَكُم بَيۡنَكُم بِٱلۡبَٰطِلِ إِلَّآ أَن تَكُونَ تِجَٰرَةً عَن تَرَاضٖ مِّنكُمۡۚ ٢٩﴾ [النساء : ٢٩]
“হে ঈমানদারগন তোমরা একে অপরের মাল অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ”। [সূরা আন-নিসা, আয়াত: ২৯]
জাবির রাদিয়াল্লাহু আনহু এভাবে বর্ণনা করেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
«رَحِمَ اللَّهُ رَجُلًا سَمْحًا إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى».
“আল্লাহ তার প্রতি দয়া বর্ষণ করুক যে বিক্রির সময়, ক্রয়ের সময় এবং অভিযোগের সময় সদয় থাকে”।[1]
পবিত্র কোরআনে উল্লেখ রয়েছে, 'নামাজ শেষ হওয়ার পর তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো এবং আল্লাহর ফজল (রিজিক) অন্বেষণ করো।' (সুরা জুমা, আয়াত ৯) প্রিয় রাসুল (সা.) বলেছেন, 'হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ ইবাদতের সমান গুরুত্বপূর্ণ।' কানজুল উম্মাল, খণ্ড ২. হজরত উমর (রা.) বলেছেন, 'তোমাদের কেউ যেন জীবিকার অন্বেষণ ছেড়ে অলস বসে না থাকে। হালাল জীবিকা উপার্জনের যত পদ্ধতি আছে, ব্যবসা-বাণিজ্যই এসবের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। 'পৃথিবীতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে ব্যবসাই সবচেয়ে বড় উপার্জনের মাধ্যম। সভ্যতা-সংস্কৃতির উপকরণগুলোর মধ্যে এটিই অন্যতম উপকরণ।' আলা মাজাহিবুল আরবায়া, খণ্ড ২, পৃষ্ঠা ২০২.অর্থনৈতিক অগ্রগতি ও প্রাধান্যের অন্তর্নিহিত রহস্য সবচেয়ে বেশি ব্যবসা-বাণিজ্যে। এ অঙ্গনে যে জাতি যত বেশি মনোযোগী হয়, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তারাই তত বেশি স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। ইসলাম ব্যবসা-বাণিজ্যকে বিশেষভাবে গুরুত্ব এবং ব্যাপক উৎসাহ দিয়েছে।
জীবিকা নির্বাহের প্রয়োজনে মানুষকে উপার্জনের নানাবিধ পথ বেছে নিতে হয়। ইসলামের দিকনির্দেশনা হ'ল হালাল পথে জীবিকা উপার্জন করা। হারাম পথে উপার্জিত অর্থ-সম্পদ ভোগ করে ইবাদত-বন্দেগী করলে তা আল্লাহ্র নিকট গৃহীত হবে না। কারণ ইবাদত কবুলের আবশ্যিক পূর্বশর্ত হ'ল হালাল উপার্জন।
[১] ক্বিয়ামতের ময়দানে বনু আদমকে পাঁচটি প্রশ্ন করা হবে এবং এর যথাযথ উত্তর না দেওয়া পর্যন্ত কোন মানুষ সামান্য পরিমাণ সামনে অগ্রসর হ'তে পারবে না। তান্মধ্যে একটি হ'ল 'সে কোন পথে অর্থ উপার্জন করেছে'।
[২] রাসূলুলাহ (ছাঃ)-কে সর্বোত্তম উপার্জন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হ'লে তিনি বলেন,
أَطْيَبُ الْكَسْبِ عَمَلُ الرَّجُلِ بِيَدِهِ، وَ كُلُّ بَيْعٍ مَبْرُوْرٍ
'নিজ হাতে কাজ করা এবং হালাল পথে ব্যবসা করে যে উপার্জন করা হয় তা-ই সর্বোত্তম'।
[৩] মহান আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا لَا تَأْكُلُوْا أَمْوَالَكُمْ بَيْنَكُمْ بِالْبَاطِلِ إِلاَّ أَنْ تَكُوْنَ تِجَارَةً عَنْ تَرَاضٍ مِنْكُمْ
'হে ঈমানদারগণ! তোমরা একে অপরের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষণ করো না। কেবলমাত্র তোমাদের পরস্পরের সম্মতিক্রমে যে ব্যবসা করা হয় তা বৈধ' (নিসা ২৯)
আল্লাহ আরো বলেন,
فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلَاةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ
'যখন ছালাত শেষ হয়ে যাবে তখন তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহ্র অনুগ্রহ (জীবিকা) তালাশ কর' (জুম'আ ১০)
রাসূল (ছাঃ) বলেছেন,
التَّاجِرُ الصَّدُوْقُ الْأَمِيْنُ مَعَ النَّبِيِّيْنَ والصِّدِّقِيْنَ وَ الشُّهَدَاءِ،
'সত্যবাদী আমানতদার ব্যবসায়ী ক্বিয়ামতের দিন নবী, ছিদ্দীক্ব এবং শহীদগণের সাথে থাকবে'।
[৪] ব্যবসা-বাণিজ্য জীবিকা উপার্জনের সর্বোত্তম পেশা হওয়ায় মহানবী (ছাঃ), খুলাফায়ে রাশেদীনসহ অধিকাংশ ছাহাবী এর মাধ্যমেই জীবিকা নির্বাহ করতেন। কুরআনের বাণী এবং মহানবী (ছাঃ)-এর হাদীছ দ্বারা উৎসাহিত হয়ে ছাহাবীগণ জীবন-জীবিকার সন্ধানে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েন। এমনকি ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ঐ সকল ব্যবসায়ী ছাহাবীর মাধ্যমেই অবিমিশ্র-নির্ভেজাল ইসলামের আগমন ঘটে। মুসলমানদের ঐতিহ্যবাহী পেশা ব্যবসা-বাণিজ্য। সুতরাং ব্যবসা-বাণিজ্যে সততা, ন্যায়-নিষ্ঠা, বিশ্বস্ততা, আমানতদারী ইত্যাদির উপস্থিতি অতীব যরূরী।
মহান আল্লাহ বলেন,
وَأَحَلَّ اللهُ الْبَيْعَ وَحَرَّمَ الرِّبَا،
'আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল এবং সূদকে হারাম করেছেন' (বাক্বারাহ ২৭৫)
এ আয়াত থেকে বুঝা যায়, ইসলাম উপার্জনের পেশা হিসাবে হালাল পথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে যেমন উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি অবৈধ পথে অর্থ-সম্পদ উপার্জন করতেও নিষেধ করেছে। কাজেই অন্যায়, যুলুম, ধোঁকাবাজি, প্রতারণা, মুনাফাখোরী, কালোবাজারী, মওজুদদারী ইত্যাদি অবৈধ ও ইসলাম বিরোধী কার্যাবলী পরিহার করে সততার সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে। রাসূলুলাহ (ছাঃ) বললেন,
إِنَّ التُّجَّارَ يُبْعَثُوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ فُجَّارًا إِلاَّ مَنِ اتَّقَى اللهَ وَبَرَّ وَصَدَقَ
'ক্বিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসাবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, নেকভাবে সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত'।
[৫] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
مَنِ احْتَكَرَ فَهُوَ خَاطِئٌ
'যে মওজুদদারী করে সে পাপী'।
[৬] বিশিষ্ট ছাহাবী ওয়াসিলা ইবনুল আকওয়া (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আমাদের কাছে আসতেন এবং বলতেন,
يَا مَعْشَرَ التُّجَّارِ إِيَّاكُمْ وَالْكَذِبَ
'হে বণিক দল! তোমরা মিথ্যা কথা ও মিথ্যা কারবার থেকে অবশ্যই দূরে থাকবে'।
[৭] আবু কাতাদা (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন,
إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَلِفِ فِى الْبَيْعِ فَإِنَّهُ يُنَفِّقُ ثُمَّ يَمْحَقُ
'ব্যবসার মধ্যে অধিক কসম খাওয়া হ'তে বিরত থেকো। এর দ্বারা মাল বেশী বিক্রি হয়, কিন্তু বরকত বিনষ্ট হয়ে যায়'।
[৯] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
ثَلاَثَةٌ لاَ يُكَلِّمُهُمُ اللهُ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَلاَ يَنْظُرُ إِلَيْهِمْ وَلاَ يُزَكِّيْهِمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ، قَالَ أَبُوْ ذَرٍّ خَابُوْا وَخَسِرُوْا مَنْ هُمْ يَا رَسُوْلَ اللهِ قَالَ الْمُسْبِلُ وَالْمَنَّانُ وَالْمُنَفِّقُ سِلْعَتَهُ بِالْحَلِفِ الْكَاذِبِ
'তিন শ্রেণীর লোকের সাথে আল্লাহ কিবয়ামতের দিন কথা বলবেন না ও তাদের প্রতি দৃষ্টি দিবেন না এবং তাদেরকে পবিত্রও করবেন না। তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি।
আবূ যার বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল! কারা নিরাশ ও ক্ষতিগ্রস্ত?
তিনি বললেন, টাখনুর নীচে কাপড় পরিধানকারী, উপকার করে খোটা প্রদানকারী এবং ঐ ব্যবসায়ী যে মিথ্যা শপথ করে তার পণ্য বিক্রি করে'।
[১০] প্রখ্যাত ছাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী (রাঃ) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন,
জনৈক বেদুঈন একটি ছাগী নিয়ে যাচ্ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি ছাগীটি তিন দিরহামে বিক্রি করবে? লোকটি বলল, আল্লাহ্র কসম! বিক্রি করব না। কিন্তু সে পরে সেই মূল্যেই ছাগীটি বিক্রি করে দিল। আমি এ বিষয়টি রাসূলুল্লাহ্র (ছাঃ)-এর কাছে এসে উল্লেখ করলাম। তিনি আমার কথাগুলো শুনে বললেন,
بَاعَ آخِرَتَهُ بِدُنْيَاهُ
'লোকটি দুনিয়ার বিনিময়ে তার পরকালকে বিক্রি করে দিয়েছে'।
[১১] আবু হুরায়রা (রাঃ) হ'তে বর্ণিত,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ مَرَّ عَلَى صُبْرَةِ طَعَامٍ فَأَدْخَلَ يَدَهُ فِيْهَا فَنَالَتْ أَصَابِعُهُ بَلَلاً فَقَالَ مَا هَذَا يَا صَاحِبَ الطَّعَامِ، قَالَ أَصَابَتْهُ السَّمَاءُ يَا رَسُوْلَ اللهِ، قَالَ أَفَلاَ جَعَلْتَهُ فَوْقَ الطَّعَامِ كَىْ يَرَاهُ النَّاسُ مَنْ غَشَّ فَلَيْسَ مِنِّىْ
'একদা নবী করীম (ছাঃ) কোন এক খাদ্যস্তূপের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি খাদ্যস্তূপে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দেখলেন তার হাত ভিজে গেছে। তিনি বললেন, হে খাদ্যের মালিক! ব্যাপার কি? উত্তরে খাদ্যের মালিক বললেন, হে আল্লাহ্র রাসূল (ছাঃ)! বৃষ্টিতে উহা ভিজে গেছে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) তাকে বললেন, 'তাহ'লে ভেজা অংশটা শস্যের উপরে রাখলে না কেন? যাতে ক্রেতারা তা দেখে ক্রয় করতে পারে। নিশ্চয়ই যে প্রতারণা করে সে আমার উম্মত নয়'।
[১২] রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) আরো বলেন,
اَلْبَيِّعَانِ بِالْخِيَارِ مَا لَمْ يَتَفَرَّقَا أَوْ قَالَ حَتَّى يَتَفَرَّقَا فَإِنْ صَدَقَا وَبَيَّنَا بُوْرِكَ لَهُمَا فِي بَيْعِهِمَا وَإِنْ كَتَمَا وَكَذَبَا مُحِقَتْ بَرَكَةُ بَيْعِهِمَا
'ক্রেতা বিক্রেতা যতক্ষণ বিচ্ছিন্ন হয়ে না যায়, ততক্ষণ তাদের চুক্তি ভঙ্গ করার ঐচ্ছিকতা থাকবে। যদি তারা উভয়েই সততা অবলম্বন করে ও পণ্যের দোষ-ত্রুটি প্রকাশ করে, তাহ'লে তাদের পারস্পরিক এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি তারা মিথ্যার আশ্রয় নেয় এবং পণ্যের দোষ গোপন করে তাহ'লে তাদের এ ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত শেষ হয়ে যাবে'।
[১৩] অপরাধ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন,
لاَ تَنَاجَشُوْا
'তোমরা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার লক্ষ্যে ক্রেতার মূল্যের উপর মূল্য বৃদ্ধি করে ক্রেতাকে ধোঁকা দিয়ো না'।
[১৪] মহান আল্লাহ বলেন,
وَيْلٌ لِلْمُطَفِّفِيْنَ، اَلَّذِيْنَ إِذَا اكْتَالُوْا عَلَى النَّاسِ يَسْتَوْفُوْنَ، وَإِذَا كَالُوْهُمْ أَوْ وَزَنُوْهُمْ يُخْسِرُوْنَ، أَلاَ يَظُنُّ أُولَئِكَ أَنَّهُمْ مَبْعُوْثُوْنَ، لِيَوْمٍ عَظِيْمٍ، يَوْمَ يَقُوْمُ النَّاسُ لِرَبِّ الْعَالَمِيْنَ
'যারা ওযনে কম দেয় তাদের জন্য ধ্বংস। তারা যখন লোকদের কাছ থেকে কিছু মেপে নেয়, তখন পুরাপুরি নেয়। আর যখন তাদের মেপে বা ওযন করে দেয় তখন কম করে দেয়। তারা কি ভেবে দেখে না যে, তারা সেই কঠিন দিনে পুনরুত্থিত হবে, যেদিন সকল মানুষ স্বীয় প্রতিপালকের সম্মুখে দন্ডায়মান হবে' (মুতাফ্ফিফীন ১৫)
আল্লাহ অনত্র বলেন,
وَأَقِيْمُوا الْوَزْنَ بِالْقِسْطِ وَلاَ تُخْسِرُوا الْمِيْزَانَ
'তোমরা ন্যায্য ওযন কায়েম কর এবং ওযনে কম দিয়ো না' (আর-রহমান ৯)
হালাল-হারাম ইসলামের এক অনন্য অলঙ্ঘনীয় বিষয়। জীবিকা উপার্জনের ইসলাম অনুমোদিত মাধ্যমগুলোর অন্যতম হলো ব্যবসা।
মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যবসায়ী। অর্থনৈতিক চরম মন্দার সময়ও তিনি ছিলেন বহুগুণ মুনাফা অর্জনকারী সফল ব্যবসায়ী। যখন পৃথিবীর সব ব্যবসায়ীই লোকসান হতো তখনও তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে সততা দিয়ে প্রচুর লাভ অর্জনের চমক দেখানো যায়।
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্রয়-বিক্রয় ব্যয়সায় অভিহিত হওয়ার জন্য শর্ত হলো তা হতে হবে সম্পূর্ণ হালাল পন্থায়। হালাল-হারামের সীমা অতিক্রম করলেই তা আর ব্যবসা থাকে না বরং তা হয়ে যায় প্রতারণা।
হালাল ব্যবসার শর্তগুলোর অন্যতম হলো ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সম্মতি।
ব্যবসার জন্য শর্ত রয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের সন্তুষ্টির। অর্থাৎ ক্রেতার পণ্যটি নেয়ার আগ্রহ থাকবে, বিক্রেতারও তা বিক্রির আগ্রহ থাকতে হবে। উভয়ে যদি ধার্যকৃত মূল্যে সন্তুষ্ট থাকেন তবেই ক্রয়-বিক্রয় শুদ্ধ হবে।
বিক্রেতা যদি জোর করে ক্রেতার ওপর কোনো জিনিস চাপিয়ে দেন অথবা ক্রেতা যদি জোর করে বিক্রেতার সন্তুষ্টি ছাড়াই তার জিনিসটি নিয়ে নেন, তা হলে তা ব্যবসা হবে না; বরং তা হবে জুলুম।
জীবিকা হালাল হওয়ার কারণে তার সব ইবাদত আল্লাহর দরবারে কবুল হয়ে যায়। সামান্য ইবাদতেই সে আল্লাহতায়ালার নৈকট্যপ্রাপ্ত হয়ে যায়। আবার হালালভাবে ব্যবসা পরিচালনা করায় সে হাশরের ময়দানে এক মহান পুরস্কারে ভূষিত হবেন। তা হলো ওই লোকটি হাশরের ময়দানে বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহর সঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করবেন।
হালাল ব্যবসার বিষয়ে ইসলামের দিক নির্দেশনা :
মানুষের জীবন ধারণ এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্ব আদিকাল থেকেই স্বীকৃত। তবে জীবনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে এরূপ ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে নিজেদের রক্ষা করা মুমিনদের কর্তব্য। এজন্য জুম‘আর ছালাতের সময় ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ রাখতে নির্দেশ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِذَا نُوْدِيْ لِلصَّلاَةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللهِ وَذَرُوا الْبَيْعَ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَّكُمْ إِنْ كُنتُمْ تَعْلَمُوْنَ- فَإِذَا قُضِيَتِ الصَّلاَةُ فَانْتَشِرُوْا فِي الْأَرْضِ وَابْتَغُوْا مِنْ فَضْلِ اللهِ وَاذْكُرُوا اللهَ كَثِيْراً لَّعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! জুম‘আর দিনে যখন ছালাতের জন্য আহবান করা হয় তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণে ধাবিত হও এবং ক্রয়-বিক্রয় ত্যাগ কর, এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয় যদি তোমরা উপলব্ধি কর। আর ছালাত সমাপ্ত হ’লে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ অন্বেষণ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (জুম‘আ ৬২/৯-১০)। উপরোক্ত আয়াতগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা রয়েছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ (রাঃ) বলেন, কোন ব্যক্তি যখন ত্যাগ স্বীকার করে ছওয়াবের আশায় মুসলিম জনপদে কোন প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানী করে এবং ন্যায্য মূল্যে তা বিক্রয় করে, আল্লাহর নিকট তিনি শহীদের মর্যাদা লাভ করেন।[4]
কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তা‘আলা ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসঙ্গে তিজারাহ (ةجارة), বায়উন (بيع), শিরা (شراء) এ তিনটি শব্দ ব্যবহার করেছেন। আল-কুরআনে ৮টি স্থানে তিজারাহ (ةجارة)[5] ৭টি স্থানে বায়‘ (بيع)[6] এবং ১৪টি স্থানে শিরা (شراء)[7] শব্দ উল্লিখিত হয়েছে।
হালাল ব্যবসা-বাণিজ্য : নিম্নোক্ত পাঁচটি পদ্ধতিতে ব্যবসা করলে তা হালাল হিসাবে ইসলামী শরী‘আত কর্তৃক অনুমোদিত হয়।
(১) বায়‘উ মুরাবাহ : লাভ-লোকসানের ভিত্তিতে নগদ মূল্যে ক্রয়-বিক্রয়ের একক ব্যবসা।
(২) বায়‘উ মুয়াজ্জাল : ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোন সময়ে এক সাথে অথবা কিস্তিতে উভয় পক্ষের সম্মতিতে মূল্য পরিশোধের শর্তে ক্রয়-বিক্রয়।
(৩) বায়‘উস সালাম : ভবিষ্যতে নির্ধারিত কোন সময়ে সরবরাহের শর্তে এবং তাৎক্ষণিক উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ সাপেক্ষে নির্দিষ্ট পরিমাণ শরী‘আত অনুমোদিত পণ্য সামগ্রীর অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয়। আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন,
قَدِمَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الْمَدِيْنَةَ، وَالنَّاسُ يُسْلِفُوْنَ فِى الثَّمَرِ الْعَامَ وَالْعَامَيْنِ أَوْ قَالَ عَامَيْنِ أَوْ ثَلاَثَةً. شَكَّ إِسْمَاعِيْلُ فَقَالَ مَنْ سَلَّفَ فِىْ تَمْرٍ فَلْيُسْلِفْ فِىْ كَيْلٍ مَعْلُوْمٍ، وَوَزْنٍ مَعْلُوْمٍ
‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) যখন মদীনায় আসলেন তখন লোকেরা (ফল-ফসলের জন্য) অগ্রিমমূল্য প্রদান করত। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি অগ্রিম মূল্য প্রদান করবে সে যেন তা সুনির্দিষ্ট মাপের পাত্রের দ্বারা ও সুনির্দিষ্ট ওযনে প্রদান করে’।
(৪) বায়‘উ মুযারাবা : এক পক্ষের মূলধন এবং অপরপক্ষের দৈহিক ও বুদ্ধিভিত্তিক শ্রমের সমন্বয়ে যৌথ ব্যবসা।[9] এ পদ্ধতিতে লভ্যাংশ তাদের মাঝে চুক্তিহারে বণ্টিত হবে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) খাদীজা (রাঃ)-এর মূলধন দ্বারা এরূপ যৌথ ব্যবসা করেছিলেন। ছাহাবায়ে কেরাম অনেকেই এ পদ্ধতিতে ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। মুযারাবায় যে ব্যক্তি পুঁজির যোগান দেয় তাকে ছাহিবুল মাল صاحب المال বা রাববুল মাল (رب المال) এবং শ্রমদানকারী তথা ব্যবসা পরিচালককে মুযারিব (مضارب) বা উদ্যোক্তা বলা হয়। এখানে ছাহিবুল মাল-এর পুঁজি হচ্ছে ব্যবসায় প্রদত্ত অর্থ-সম্পদ আর মুযারিবের পুঁজি হচ্ছে দৈহিক ও বুদ্ধিভিত্তিক শ্রম।
মুযারাবা কারবারে লাভ হ’লে ব্যবসায় শুরুতে কৃত চুক্তির শর্তানুসারে ছাহিবুল মাল এবং মুযারিব উভয়েই উক্ত লাভ ভাগ করে নেয়। পক্ষান্তরে ব্যবসায় লোকসান হ’লে সম্পূর্ণ লোকসান কেবল ছাহিবুল মাল তথা পুঁজি বিনিয়োগকারীকেই বহন করতে হয়। আর এ ক্ষেত্রে মুযারিবের ব্যয়িত শ্রম, বুদ্ধি ও সময় বৃথা যায়। মুযারিব কোন লাভ পায় না এটাই তার লোকসান। তবে ব্যবসা পরিচালনায় মুযারিবের অবহেলা কিংবা চুক্তির শর্ত ভঙ্গের কারণে লোকসান হ’লে সেক্ষেত্রে লোকসানের দায়ভার মুযারিবকেই বহন করতে হবে। কেননা এ ক্ষেত্রে পুঁজির মালিকের কোন ভূমিকা থাকে না।
(৫) বায়‘উ মুশারাকা : মূলধন ও লভ্যাংশের ব্যাপারে দুই বা ততোধিক অংশীদারের মধ্যকার চুক্তি অনুসারে ব্যবসা।
মুশারাকা পদ্ধতিতে ব্যবসায় লাভ হ’লে অংশীদারগণ পূর্ব নির্ধারিত অনুপাতে তা ভাগ করে নেয়। আর লোকসান হ’লে অংশীদারগণ নিজ নিজ পুঁজির আনুপাতিক হারে তা বহন করে।
হালাল ব্যবসা-বাণিজ্যের স্বরূপ :
ব্যবসা হালাল হওয়ার জন্য কতিপয় বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে এবং সেগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। অন্যথা ব্যবসা বৈধ হবে না। এখানে সংক্ষেপে সেগুলি আলোচনা করা হ’ল।
সততা : সততা, আমানতদারী ও বিশ্বস্ততা ব্যবসা হালাল হওয়ার পূর্বশর্ত। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, إن التجار يحشرون يوم القيامة فجارا إلا من اتقى وبر وصدق ‘ক্বিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহা অপরাধী হিসাবে উত্থিত হবে। তবে যারা আল্লাহকে ভয় করবে, সততা ও ন্যায় নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা করবে তারা ব্যতীত’।
মূল্য নির্ধারণ :
মূল্য নির্ধারণ বলতে পণ্যের এমন একটি নির্দিষ্ট মূল্য নির্ধারণ বুঝায়, যাতে লভ্যাংশ থাকবে যেন পণ্যের মালিক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, আবার উক্ত পণ্যের ভোক্তাদের জন্যও কষ্টসাধ্য না হয়।
আনাস (রাঃ) বলেন, غَلاَ السِّعْرُ عَلَى عَهْدِ رَسُوْلِ اللهِ صلى الله عليه وسلم فَقَالُوْا يَا رَسُوْلَ اللهِ سَعِّرْ لَنَا. فَقَالَ إِنَّ اللهَ هُوَ الْمُسَعِّرُ الْقَابِضُ الْبَاسِطُ الرَّزَّاقُ وَإِنِّىْ لأَرْجُو أَنْ أَلْقَى رَبِّىْ وَلَيْسَ أَحَدٌ مِنْكُمْ يَطْلُبُنِىْ بِمَظْلَمَةٍ فِىْ دَمٍ وَلاَ مَالٍ- ‘রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর যুগে (একবার পণ্যের) মূল্য বেড়ে গেল। তখন ছাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের জন্য মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন তিনি বললেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহই হচ্ছেন মূল্য নির্ধারণকারী; তিনি সঙ্কোচনকারী, সম্প্রসারণকারী ও রিযিকদাতা। আর আমি অবশ্যই এমন এক অবস্থায় আমার রবের সাথে সাক্ষাৎ করার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করি যাতে তোমাদের মধ্য থেকে কেউ আমার বিরুদ্ধে রক্ত (প্রাণ) ও সম্পদ সম্পর্কে যুলুমের অভিযোগ উত্থাপন করতে না পারে’।
আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, এক ব্যক্তি এসে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আমাদের দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করে দিন। তখন তিনি বললেন, بَلِ اللهُ يَخْفِضُ وَيَرْفَعُ وَإِنِّىْ لأَرْجُو أَنْ أَلْقَى اللهَ وَلَيْسَ لأَحَدٍ عِنْدِىْ مَظْلَمَةٌ ‘বরং আল্লাহই সঙ্কোচন-সম্প্রসারণ করেন। আমি অবশ্যই এমতাবস্থায় আল্লাহর সাথে মিলিত হ’তে চাই যে, আমার পক্ষ থেকে কারো প্রতি সামান্যতম যুলুমও থাকবে না’।
ইমাম শাওকানী (রহঃ) বলেন, দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয়া হারাম। কারণ তা যুলুমের নামান্তর। কেননা মানুষ তার সম্পদের উপর কর্তৃত্বের অধিকারী অথচ দ্রব্যমূল্য নির্ধারণ করে দেয়াটা এর প্রতিবন্ধক স্বরূপ। রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের কল্যাণ হেতু দ্রব্যমূল্য কম রাখার ও উৎপাদন বৃদ্ধির যাবতীয় ব্যবস্থা করবে, এটাই তার বড় দায়িত্ব।
লাভের পরিমাণ :
কোন পণ্যে কত লাভ করা যাবে এরূপ কোন নির্দেশনা কুরআন-হাদীছে পাওয়া যায় না। আবার সকল পণ্যে এক রকম লাভ করা যাবে না এরূপ কোন নিষেধাজ্ঞাও নেই। আসলে শরী‘আতে বিষয়টিকে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। কারণ লাভ নির্ণয়ের বিষয়টি নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্র ভেদে পরিস্থিতি-পরিবেশের উপর। তবে লাভের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন সীমা সম্পর্কে একটা ধারণা আমরা হাদীছ থেকে লাভ করতে পারি। উরওয়া ইবনে আবিল জাদ আল-বারেকী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
عَرَضَ لِلنَّبِىِّ صلى الله عليه وسلم جَلَبٌ فَأَعْطَانِى دِيْنَاراً وَقَالَ أَىْ عُرْوَةُ ائْتِ الْجَلَبَ فَاشْتَرِ لَنَا شَاةً. فَأَتَيْتُ الْجَلَبَ فَسَاوَمْتُ صَاحِبَهُ فَاشْتَرَيْتُ مِنْهُ شَاتَيْنِ بِدِيْنَارٍ فَجِئْتُ أَسُوْقُهُمَا أَوْ قَالَ أَقُوْدُهُمَا فَلَقِيَنِىْ رَجُلٌ فَسَاوَمَنِىْ فَأَبِيْعُهُ شَاةً بِدِيْنَارٍ فَجِئْتُ بِالدِّيْنَارِ وَجِئْتُ بِالشَّاةِ فَقُلْتُ يَا رَسُوْلَ اللهِ هَذَا دِيْنَارُكُمْ وَهَذِهِ شَاتُكُمْ. قَالَ وَصَنَعْتَ كَيْفَ. قَالَ فَحَدَّثْتُهُ الْحَدِيْثَ فَقَالَ اللَّهُمَّ بَارِكْ لَهُ فِىْ صَفْقَةِ يَمِيْنِهِ.
‘নবী করীম (ছাঃ)-এর নিকট পশুর একটি চালানের সংবাদ আসল। তিনি আমাকে একটি দীনার দিয়ে বললেন, উরওয়া! তুমি চালানটির নিকট যাও এবং আমাদের জন্য একটি বকরী ক্রয় করে নিয়ে আস। তখন আমি চালানটির কাছে গেলাম এবং চালানের মালিকের সাথে দরদাম করে এক দীনার দিয়ে দুইটি বকরী ক্রয় করলাম। বকরী দু’টি নিয়ে আসার পথে এক লোকের সাথে দেখা হয়। লোকটি আমার থেকে বকরী ক্রয় করার জন্য আমার সাথে দরদাম করল। তখন আমি তার নিকট এক দীনারের বিনিময়ে একটি বকরী বিক্রয় করলাম এবং একটি বকরী ও একটি দীনার নিয়ে চলে এলাম। তখন আমি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! এই হচ্ছে আপনার দীনার এবং এই হচ্ছে আপনার বকরী। তখন রাসূল (ছাঃ) বললেন, এটা করলে কিভাবে? উরওয়া বলেন, আমি তখন তাঁকে ঘটনাটি বললাম। তখন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বললেন, হে আল্লাহ! আপনি তার হাতের লেন-দেনে বরকত দিন’।[20]
উল্লেখ্য, উক্ত ছাহাবী রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর পক্ষে ১০০% লাভ করা সত্ত্বেও রাসূল (ছাঃ) তার জন্য বরকতের দো‘আ করেছেন এবং এ দো‘আর ফলে উক্ত ছাহাবী জীবনে প্রচুর বরকত লাভে ধন্য হয়েছেন। বুখারীর বর্ণনায় এসেছে, উক্ত ছাহাবী মাটি ক্রয় করলেও তাতে লাভ হ’ত। সুতরাং মজুতদারী না করে, প্রতারণার আশ্রয় না নিয়ে ক্রেতার স্বাভাবিক ও স্বেচ্ছা সম্মতির ভিত্তিতে কোন পণ্য বিক্রি করে বিক্রেতা ১০০% লাভ করলেও শরী‘আতে কোন বাধা নেই। তবে এক্ষেত্রে ক্রেতা বা ভোক্তা যেন যুলুমের শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা যরূরী।
লাভের সর্বনিম্ন সীমা সম্পর্কে ইসলামী চিন্তাবিদগণ বলেছেন, সম্পদ ব্যবসায় বিনিয়োগ করলে কমপক্ষে এতটুকু লাভ করা যায় যাতে ব্যবসায়ীর পরিবারের ভরণ-পোষণ, ব্যবসার কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদান ও ২.৫% যাকাত দেয়ার পর মূলধন অক্ষত থাকে। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও পাওনা আদায়ের ক্ষেত্রে মানুষের সাথে দয়ার্দ্র, নম্র ও সদ্ব্যবহার পূর্বক ন্যায্য মূল্য গ্রহণ করা অত্যন্ত নেক কাজ। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, رَحِمَ اللهُ رَجُلاً سَمْحًا إِذَا بَاعَ، وَإِذَا اشْتَرَى، وَإِذَا اقْتَضَى ‘আল্লাহ ঐ মহানুভব মানুষের প্রতি দয়া করেন, যে ক্রয়-বিক্রয়ে এবং নিজের পাওনা আদায়ে নম্রতা ও সহনশীলতা প্রদর্শন করে’।
হারাম দ্রব্যের ব্যবসাও হারাম :
আল্লাহ তা‘আলা মদ, মৃত প্রাণী, রক্ত, প্রতিমা এবং শূকরের গোশত প্রভৃতি হারাম করেছেন। তিনি বলেন, حُرِّمَتْ عَلَيْكُمُ الْمَيْتَةُ وَالدَّمُ وَلَحْمُ الْخِنْزِيْرِ ‘তোমাদের প্রতি মৃতপ্রাণী, রক্ত, শূকরের গোশত হারাম করা হয়েছে’ (মায়েদাহ ৫/৩)।
অন্যত্র তিনি বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْخَمْرُ وَالْمَيْسِرُ وَالْأَنْصَابُ وَالْأَزْلَامُ رِجْسٌ مِنْ عَمَلِ الشَّيْطَانِ فَاجْتَنِبُوْهُ لَعَلَّكُمْ تُفْلِحُوْنَ ‘হে ঈমানদারগণ! নিশ্চয়ই মদ, জুয়া, প্রতিমা এবং ভাগ্য নির্ধারক শরসমূহ শয়তানের অপবিত্র কার্য বৈ কিছুই নয়। অতএব এগুলো থেকে বিরত থাক, যাতে তোমরা সফলকাম হও’ (মায়েদাহ ৫/৯০)।
আল্লাহ তা‘আলা যেসব দ্রব্য হারাম করেছেন, সেসব দ্রব্যের ব্যবসাও হারাম করেছেন। জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে মক্কা বিজয়ের বছর এবং মক্কা থাকাবস্থায় বলতে শুনেছেন, তিনি বলেছেন,
إِنَّ اللهَ وَرَسُوْلَهُ حَرَّمَ بَيْعَ الْخَمْرِ وَالْمَيْتَةِ وَالْخِنْزِيْرِ وَالأَصْنَامِ. فَقِيْلَ يَا رَسُوْلَ اللهِ، أَرَأَيْتَ شُحُوْمَ الْمَيْتَةِ فَإِنَّهَا يُطْلَى بِهَا السُّفُنُ، وَيُدْهَنُ بِهَا الْجُلُوْدُ، وَيَسْتَصْبِحُ بِهَا النَّاسُ. فَقَالَ لاَ، هُوَ حَرَامٌ. ثُمَّ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم عِنْدَ ذَلِكَ قَاتَلَ اللهُ الْيَهُوْدَ، إِنَّ اللهَ لَمَّا حَرَّمَ شُحُوْمَهَا جَمَلُوْهُ ثُمَّ بَاعُوْهُ فَأَكَلُوْا ثَمَنَهُ.
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ও তাঁর রাসূল মদ, মৃত দেহ, শূকর ও প্রতিমা বেচা-কেনাকে হারাম করেছেন। তখন বলা হ’ল, হে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ)! আপনি কি মনে করেন যে, লোকেরা মৃত পশুর চর্বি দ্বারা নৌকায় প্রলেপ দেয়, তা দিয়ে চামড়ায় বার্ণিশ করে এবং লোকেরা তা চকচকে করার কাজে ব্যবহার করে? তখন তিনি বললেন, না, তা হারাম। অতঃপর তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা ইহুদীদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেন, কারণ মহান আল্লাহ তাদের জন্য চর্বি হারাম করেছেন অথচ তারা একে গলিয়ে নেয় এবং তা বিক্রি করে ও তার মূল্য ভক্ষণ করে’।[22] অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, لَعَنَ اللهُ الْخَمْرَ وَشَارِبَهَا وَسَاقِيَهَا وَبَائِعَهَا وَمُبْتَاعَهَا وَعَاصِرَهَا وَمُعْتَصِرَهَا وَحَامِلَهَا وَالْمَحْمُوْلَةَ إِلَيْهِ ‘আল্লাহ লা‘নত বর্ষণ করেন মদের উপর এবং যে তা পান করে, যে তা পরিবেশন করে, যে তা বিক্রি করে, যে তা ক্রয় করে, যে তার নির্যাস তৈরী করে, যার জন্য নির্যাস তৈরী করা হয়, যে তা বহন করে আর যার কাছে বহন করে নিয়ে যাওয়া হয় সবার উপর’।
বায়‘উল ঈনা তথা পাতানো ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ :
ইসলামী শরী‘আত বায়‘উল ঈনা তথা পাতানো ক্রয়-বিক্রয়কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। বায়‘উল ঈনার প্রকৃতি সম্পর্কে শায়খুল ইসলাম ইবনু তায়মিয়াহ (রহঃ) বলেছেন,
والعينة ان يبيع ثيئا إلى غيره بثمن معين (مائة وعشريث ريمنار مثلا) إلى اجل (سنة مثلا) ويسلمه إلى المشترى ثم يشتريه قبل قبض الثمن بثمن اقلى من ذلك القدر (بمائة مثلا) يدفعه نقدًا-
‘বায়‘উল ঈনা হচ্ছে কারো নিকট কোন বস্তত নির্দিষ্ট দামে (যেমন ১২০ দীনারে) নির্দিষ্ট মেয়াদের (যেমন ১ বছরের) জন্য বিক্রি করা এবং বস্ত্তটি ক্রেতাকে বুঝিয়ে দেয়া। অতঃপর বস্ত্তটির মূল্য (যেমন ১২০ দীনার) বুঝে পাওয়ার পূর্বে তা উক্ত ক্রেতার নিকট হ’তে তার চেয়ে কমমূল্যে (যেমন ১০০ দিনারে) ক্রয় করে নিয়ে নগদ মূল্য পরিশোধ করে দেয়া। ফলাফল হচ্ছে, ক্রেতাকে দিল ১০০ দীনার আর মেয়াদান্তে তার থেকে গ্রহণ করল ১২০ দীনার’।[24] মোল্লা আলী ক্বারী বলেন,هو أن يبيع من رجل سلعة بثمن معلوم إلى أجل مسمى ثم يشتريها منه بأقل من الثمن الذي باعها ‘বায়‘উল ঈনা হচ্ছে কোন ব্যক্তি নির্দিষ্ট দামে নির্ধারিত সময়ের জন্য কোন পণ্য বিক্রি করল। অতঃপর বিক্রয় মূল্যের চেয়ে কম দামে তা পুনরায় ক্রয় করল’।
বায়‘উল ঈনা আসলে এক ধরনের পাতানো ক্রয়-বিক্রয়। এরূপ লেন-দেনকারীদের বাস্তবে পণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের কোন উদ্দেশ্য থাকে না এবং যে পণ্যটি তারা ক্রয়-বিক্রয়ের কথা বলে তা ক্রয় করার যেমন কোন প্রয়োজন ক্রেতার থাকে না, তেমনি বিক্রেতারও তা বিক্রি করার কোন প্রয়োজন থাকে না। ক্রয়-বিক্রয় পাতানো হওয়ার কারণে বিক্রিত বস্ত্তটি পূর্বে যার ছিল তার কাছেই থেকে যায়। ক্রেতা পণ্যের ভোগ-ব্যবহারও করে না এবং তা অন্যত্র বিক্রি করে ব্যবসাও করে না। এটা সম্পূর্ণ রূপে একটা পাতানো ক্রয়-বিক্রয়। এটা সরাসরি সূদ না খেয়ে ঘুরিয়ে সূদ খাওয়ার নামান্তর।
মানবতার মুক্তির দিশারী মুহাম্মাদ (ছাঃ) অন্ধকারাচ্ছন্ন, পাপ-পঙ্কিলতাময় এ বসুন্ধরায় জাহেলিয়াতের সকল অন্যায়-অত্যাচার, অবিচার-অশান্তি, অস্থিতিশীল অর্থনৈতিক কর্মকান্ড বন্ধ করে দিয়েছিলেন। বিশেষ করে মানব নিষ্পেষণ ও সমাজ বিধ্বংসী অন্যতম মাইন সূদ, ঘুষ, লটারী ও মজুতদারী প্রভৃতি তিরোহিত করেন। আল্লাহ প্রেরিত সর্বশেষ অহি-র আলোকে হালাল ব্যবসা ভিত্তিক একটি সর্বোত্তম, অভূতপূর্ব আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এক কথায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসলামের রয়েছে সঠিক কল্যাণকামী দিক নির্দেশনা। The Quran in everyday life গ্রন্থকার বলেন, All individual, Social, political, Finential and others problems which relating with human being, human welfare or human nature have been Completely discussed in the Quran. ‘ব্যক্তিগত, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য সমস্যাবলী যা মানবজাতি, মানবকল্যাণ অথবা মানব প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত তার সবই পূর্ণাঙ্গভাবে আলোচিত হয়েছে আল-কুরআনে’।
নারীর অর্থ উপার্জন ও সম্পদের মালিকানা অর্জন
এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে নারীর অর্থোপার্জন এবং খরচের বিষয়টিও আলোচনা করা জরুরি মনে করছি। কারণ, এ নিয়ে অকারণে সৃষ্টি করা হয়েছে অনেক কল্পকাহিনী। ইসলাম পুরুষের মতো নারীর অর্জিত সম্পদের মালিকানা নারীকেই দিয়েছে (সূরা আন্নিসা: আয়াত৩২)। পুরুষের মতোই শরিয়া অনুমোদিত প্রক্রিয়ায় নারীর অর্জিত ও উপার্জিত নিজের অর্থ সম্পদের বিনিয়োগ, উন্নয়ন ও ব্যয় ব্যবহারের অধিকার তার নিজের জন্যে সংরক্ষিত। তবে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপনে এবং পরিবার পরিচালনায় অর্থ ব্যয়ের দায়িত্ব পুরুষের । এ ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃত ছাড়া নারীর অর্থ ব্যয় হয়না। নারীর আয়ের উৎস অধিক, ব্যয়ের বাধ্যতামূলক খাত একেবারেই সীমিত। তার ব্যয়ের খাত স্বাধীন সেচ্ছোমূলক। ইসলামের
দৃষ্টিতে নারীর আয় ও অর্জনের উৎস সমূহ নিম্নরূপ:
০১. লালন পালন ও পড়া লেখার অর্থ পাবেন পিতার নিকট থেকে।
০২. বিবাহের অর্থ প্রদান করবেন পিতা এবং স্বামী।
০৩. বিবাহে স্বামীর নিকট থেকে মোহরানা লাভ।
০৪. ঘর বাড়ি নির্মাণ খরচ বা বাসা ভাড়া পাবেন স্বামীর নিকট থেকে।
০৫. খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসার অর্থ পাবেন স্বামীর নিকট থেকে।
০৬. সন্তান লালন পালন এবং তাদের শিক্ষা চিকিৎসা সহ যাবতীয় খরচের অর্থ নেবেন স্বামী থেকে।
ইসলামের দৃষ্টিতে অর্জিত সম্পদ ব্যয়ের কিছু বিধান রয়েছে
কোরআন ও হাদিসে অর্থ উপার্জন সম্পর্কে যেমন অসংখ্য নির্দেশনা রয়েছে তেমনি ব্যয় সম্পর্কেও ইসলামে রয়েছে সুন্দর বিধান। ইসলামের দৃষ্টিতে অর্জিত সম্পদ ব্যয়ের কিছু বিধান রয়েছে। সেগুলো খেয়াল রাখা খুব জরুরি। অর্থ ব্যয়ের কিছু খাত রয়েছে, সেসব খেয়াল রাখলেও ব্যয় হবে সুষম ও কল্যাণপ্রসূ। এমন কিছু বিষয় সম্পর্কে আলোকপাত করা হলো।
হুকুক : রক্ত সম্পর্কের কারণে যারা অধিকার লাভ করেছে তাদের জন্য ব্যয় করা। যেমনÑ সন্তান, পিতামাতা।
নাফকা : বৈবাহিক সম্পর্কের কারণে যারা অধিকার লাভ করে তাদের জন্য ব্যয় করা। এমনকি স্ত্রীকে তালাক দিলেও ইদ্দত পালনকালে, গর্ভে সন্তান থাকলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত এবং সন্তানকে দুধ পান করালে দুধ পান শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকে নাফকা দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে কোরআন সুরা নিসার ৩৪ আয়াত এবং সুরা তালাকের ৬ ও ৭ নং আয়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
দেনমোহর : বিয়ের সময় একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে যে অর্থ প্রদান করেন তার নাম মোহর। মোহর প্রদান করা বাধ্যতামূলক, এ প্রসঙ্গে সুরা নিসার ৪ এবং ২০ আয়াতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জাকাত ও উশর : মূলত উশর জাকাতেরই একটি অংশ। উশর হলো ফল ফসলের জাকাত। বছর শেষে হিসাব-নিকাশ করে উদ্বৃত্ত অর্থ সম্পদ থেকে শরিয়া নির্ধারিত হারে এবং খাতে একটি অংশ পরিশোধ করাকে জাকাত বলা হয়।
মান্নত : উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে কোনো ত্যাগ স্বীকার বা দান করার অঙ্গীকার করা হলো মান্নত। উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে প্রতিশ্রæত ত্যাগ স্বীকার করা বা দান করা বাধ্যতামূলক।
সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা : ঈদুল ফিতরের পূর্বে সামর্থবান ব্যক্তিগণ অভাবী ব্যক্তিদেরকে ঈদ আনন্দে শরিক করার জন্য সুন্নাহ নির্ধারিত হারে সাহায্য প্রদানকে সাদাকাতুল ফিতর বলা হয়। রাসুল (সা.) এই সাহায্য প্রদানের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন।
ওয়াকফ : কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার উৎপাদনশীল কোনো অর্থ সম্পত্তি জনকল্যাণের কাজে দান করে যাওয়াকে ওয়াকফ বলা হয়। ওয়াকফ তত্ত¡াবধানের দায়িত্ব পালন করতে হবে সরকার কিংবা জনস্বার্থে প্রতিষ্ঠিত কোনো সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে।
হেবা : হেবা হলো কোনো ব্যক্তিকে স্থায়ী ও নিঃস্বার্থভাবে নিজের কোনো সম্পদ দিয়ে দেওয়া। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘তোমরা দান কর। এতেই রয়েছে তোমাদের নিজেদের জন্য কল্যাণ। যারা মনের সংকীর্ণতা (কৃপণতা) থেকে মুক্ত হয়, তারাই ফালাহ (সফলতা) অর্জনকারী।’ (সুরা তাগাবুন : আয়াত ১৬)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে, ‘তোমরা ততক্ষণ পর্যন্ত কল্যাণ লাভ করবে না, যতক্ষণ না তোমাদের পছন্দের জিনিস দান কর। (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ৯২)
ইসলামে অর্থ সম্পদ উপার্জন ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিস্তারিত বিধান রয়েছে। উপার্জন ও ব্যয় কোনো ক্ষেত্রেই হারাম ও জবরদস্তি ইসলাম অনুমোদন করে না।
ইসলামের দৃষ্টিতে অর্জিত অর্থ সম্পদ বিনিয়োগ ব্যতিত যাবতীয় ব্যয়ের খাত
সমূহ দুই ভাগে বিভক্ত। সেগুলো হলো:
০১. বাধ্যতামূলক,
০২. স্বেচ্ছামূলক।
ইসলামে নিম্নোক্ত খাতসমূহে ব্যয় করা বাধ্যতামূলক এবং আবশ্যক:
১. হুকুক: অর্থাৎ রক্ত সম্পর্কের কারণে যারা অধিকার লাভ করেছে তাদের
জন্যে ব্যয় করা। যেমন: সন্তান, পিতামাতা।
২. নাফকা: এর অর্থ ক্সববাহিক সম্পর্কের কারণে যারা অধিকার লাভ করে
তাদের জন্যে ব্যয় করা। যেমন: স্ত্রীদের জন্যে। এমনকি স্ত্রীকে তালাক
দিলেও ইদ্দত পালন কালে, গর্ভে সন্তান থাকলে সন্তান প্রসব পর্যন্ত এবং
সন্তানকে দুধ পান করালে দুধ পান শেষ হওয়া পর্যন্ত তাকে নাফকা দিতে
হবে। এ প্রসঙ্গে কুরআন মজিদে সূরা আন নিসার ৩৪ এবং সূরা আত
তালাকের ৬-৭ আয়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
৩. বিবাহের মোহর: বিয়ের সময় একজন পুরুষ তার স্ত্রীকে যে অর্থ প্রদান
করেন তার নাম মোহর। মোহর প্রদান করা বাধ্যতামূলক, এ প্রসঙ্গে সূরা
আন নিসার ৪ এবং ২০ আয়াতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
৪. যাকাত এবং উশর: মূলত উশর যাকাতেরই একটি অংগ। উশর হলো ফল
ইসলামি অর্থনীতিতে উপার্জন ও ব্যয়ের নীতিমালা ২৫
ফসলের যাকাত। বছর শেষে হিসাব নিকাশ করে উদ্ধৃত্ত (নধষধহপব) অর্থ
সম্পদ থেকে শরিয়া নির্ধারিত হারে এবং খাতে একটি অংশ পরিশোধ
করাকে যাকাত বলা হয়। সালাত আদায় করার মতোই যাকাত আদায় করা
ফরয। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে: ‘তোমরা সালাত কায়েম করো এবং
যাকাত পরিশোধ করো।’ (সূরা আল বাকারা: আয়াত ৪৩,৮৩,১০)
৫. কাফ্ফারা: কেউ কোনো পাপ বা অপরাধ করে ফেললে তা থেকে নি®কৃতি
পওয়ার জন্যে যে নেক কাজ করতে হয়, তাকে কাফ্ফারা বলা হয়। কুরআন
মজিদে তিনটি পাপের ক্ষেত্রে কাফ্ফারার মাধ্যমে নি®কৃতি লাভের বিধান দেয়া
হয়েছে। সেগুলো হলো: ১. ইচ্ছাকৃতভাবে রমযান মাসের ফরয রোযা ভঙ্গ
করলে। ২. যিহার করলে। অর্থাৎ নিজের স্ত্রীকে বা স্ত্রীর কোনো অঙ্গকে
নিজের মা বা বোনের কোনো অঙ্গের মতো বলে তুলনা করলে। সূরা
মুজাদালার ২-৪ আয়াতে এ সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে। ৩. অংগিকার ভংগ
করলে। সূরা আল মায়িদার ৮৯ আয়াতে -এ সংক্রান্ত বিধান দেয়া হয়েছে।
এসব ক্ষেত্রে কাফ্ফারা হিসেবে রোযা রাখা কিংবা অভাবীদের খাওয়ানো,
অথবা মানুষকে দাসত্ব থেকে মুক্তিদানের কথা বলা হয়েছে।
৬. ফিদিয়া: বার্ধক্যজনিত কারণে এবং এমন রোগের কারণে- যে রোগ থেকে
নি®‥ৃতি পাওয়ার লক্ষণ দেখা যায়না রমযান মাসের ফরয রোযা রাখতে না
পারলে তার বিনিময়ে কুরআন নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় ও পরিমাণে দান করাকে
ফিদিয়া বলা হয়।
৭. নযর: নযরকে আমাদের দেশে মান্নত বলা হয়। এর অর্থ- উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে
কোনো ত্যাগ স্বীকার বা দান করার স্বগত অংগীকার করা। উদ্দেশ্য পূর্ণ হলে
প্রতিশ্রæত ত্যাগ স্বীকার করা বা দান করা বাধ্যতামূলক। যারা জান্নাতে যাবে,
সূরা আদ্দাহরের ৭ আয়াতে তাদের একটি ক্সবশিষ্ট্য উল্লেখ করা হয়েছে যে,
তারা নযর (মান্নত) পূর্ণ করে।
৮. সাদাকাতুল ফিতর বা ফিতরা: ঈদুল ফিতরের পূর্বে সামর্থবান ব্যক্তিগণ
কর্তৃক অভাবী ব্যক্তিগণকে ঈদ আনন্দে শরিক করার জন্যে সুন্নাহ নির্ধারিত
হারে সাহয্য প্রদানকে সাদাকাতুল ফিতর বলা হয়। রসূল সা. এই সাহায্য
প্রদানের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
৯. কুরবানির গোশত বিতরণ: যারা তামাত্তু হজ্জ করেন তাদেরকে বাধ্যতামূলক
কুরবানি করতে হয়। তাছাড়া সকল সামর্থবান মুসলিমকেই কুরবানি করতে
তাকিদ করা হয়েছে। কুরবানির গোশতের একটি অংশ অভাবীদের দান
করতে বলা হয়েছে।
ইসলামে মালিক- কর্মকর্তা , কমর্চারি ও শ্রমিক সম্পর্ক
ইসলাম কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিক এবং মালিকের ওপর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে অত্যাবশ্যকীয় শ্রমনীতি প্রণয়ন করেছে। মালিকের প্রধান কর্তব্য হলো কর্মক্ষম, সুদক্ষ, শক্তি-সামর্থ্যবান, আমানতদার ও বিশ্বস্ত ব্যক্তিকে কাজে নিয়োজিত করা এবং সময়, কার্যকাল ও ন্যায্য পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে জনবল নিয়োগ করা। কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিকের বেতন-ভাতা যতক্ষণ পর্যন্ত স্থির করা না হবে, এবং সন্তুষ্ট মনে সে তা গ্রহণ না করবে, ততক্ষণ জোর করে বা ভয়ভীতি দেখিয়ে তাকে কাজে নিযুক্ত করা ইসলামসম্মত নয়। কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিককে কমপক্ষে এমন পারিশ্রমিক দিতে হবে, যাতে সে এর দ্বারা তার ন্যায়ানুগ ও দৈনন্দিন জীবনের স্বাভাবিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। শ্রমিকের ন্যায্যপ্রাপ্য মজুরি পরিশোধের বিষয়ে রাসুলুল্লাহ (সা.) নির্দেশনা প্রদান করে বলেছেন, ‘শ্রমিকের গায়ের ঘাম শুকানোর আগেই তার মজুরি দিয়ে দাও।’ (ইবনে মাজা) কাজ সম্পাদন করা মাত্রই শ্রমিককে তার প্রাপ্য পারিশ্রমিক প্রদান করা মালিকের প্রাথমিক দায়িত্ব। তবে অগ্রিম বা অন্য কোনো রকম শর্ত থাকলে ভিন্ন কথা। আল্লাহ তাআলা তাদের দায়িত্ব তোমাদের ওপর অর্পণ করেছেন। মালিকেরা যা খাবে, তা কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিকদেরকেও খাওয়াবে এবং মালিকেরা যে পোশাক পরবে, তা কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিকদেরকেও পরতে দেবে। যে কাজ করা তাদের পক্ষে কষ্টকর, সাধ্যাতীত, তা করার জন্য তাদেরকে কখনো বাধ্য করবে না।’ (বুখারি)শ্রমের ব্যাপারে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে শর্ত সাপেক্ষে লিখিত চুক্তি সম্পাদন করে নেওয়া উচিত। তাহলে কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিক থেকে কাজ উসুল করে নেওয়ার পূর্ণ অধিকার মালিকের থাকবে এবং কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিক মালিকের কাছে কাজের জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। এ ক্ষেত্রে কাজে কোনো রূপ শৈথিল্য, উদাসীনতা বা গাফিলতি গ্রহণযোগ্য হবে না। কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিক তত্ত্বাবধানে যেসব প্রতিষ্ঠান বা কারখানার মূল্যবান আসবাব দেওয়া হয়, তা আমানতস্বরূপ ব্যবহার করবে এবং সেই সম্পদগুলো তুচ্ছ মনে করে চুরি, অবৈধ ব্যবহার, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ বা অন্য কোনো ধ্বংসাত্মক পন্থায় কখনোই বিনষ্ট করা যাবে না। কোনো কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিক এক কাজের জন্য চুক্তি করে তার সম্মতি ছাড়া অন্য কাজে জবরদস্তিমূলক নিয়োগ বা বদলি করাও জায়েজ নয়। কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিকদের রক্ষণাবেক্ষণ, তাদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করার দায়িত্ব মালিকদের। মালিকপক্ষ তার অধীনস্থদের নিরাপত্তা, জানমালের ক্ষয়ক্ষতি ও দুঃখ-দুর্দশা নিরসনে আন্তরিকভাবে সচেষ্ট হবে, কমর্চারি ও শ্রমিকদের ওপর কোনো রকম অন্যায়, অত্যাচার, দমন-নিপীড়ন বা নির্যাতন করতে পারবে না।কমর্চারি ও শ্রমিক-মালিকের মধ্যকার সম্পর্কের অবনতি ঘটলে শ্রমিকেরা মালিক কর্তৃক শোষিত, নির্যাতিত-নিপীড়িত হলে ভয়াবহ সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে। কমর্চারি ও শ্রমিকদের ওপর জুলুম বা নির্যাতন করলে তার কঠোর শাস্তি রয়েছে। যারা কমর্চারি ও শ্রমিকের পারিশ্রমিক ঠিকমতো আদায় করে না, তাদের সম্পর্কে মহানবী (সা.) সাবধানবাণী ঘোষণা করেছেন, ‘কিয়ামতের দিন আমি তিন ব্যক্তির প্রতিপক্ষ হব। তন্মধ্যে একজন হচ্ছে, যে ব্যক্তি কোনো কমর্চারি ও শ্রমিককে কাজে নিয়োগ করে তার কাজ আদায় করে বটে, কিন্তু তার মজুরি পরিশোধ করে না।’ (বুখারি)ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ জীবনব্যবস্থা হিসেবে কমর্চারি ও শ্রমিকদের সব সমস্যার সার্বিক ও ন্যায়ানুগ সমাধানের দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। ইসলাম চায় এমন এক ভারসাম্যপূর্ণ সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে, কমর্চারি ও শ্রমিক ও নিয়োগকর্তার সৌহার্দ্যমূলক পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তিতে এমন এক জীবনবিধানের প্রচলন করতে, যেখানে শোষণ-নিপীড়ন থাকবে না। যেহেতু সম্পদ ব্যবস্থাপনায় মালিকপক্ষ বা পুঁজিপতি তার মূলধন খাটানোর কারণে এবং শ্রমিক তার শ্রমের বিনিময়ে লাভের হকদার হয়ে থাকে, সেহেতু নবী করিম (সা.) কমর্চারি ও শ্রমিককে মজুরি দান করার পরেও তাকে লাভের অংশ দেওয়ার জন্য উপদেশ দিয়ে বলেছেন, কমর্চারি ও শ্রমিকদের তাদের শ্রমার্জিত সম্পদের লভ্যাংশ দাও। মজুরির পরিমাণ এমন হতে হবে যেন তা কোনো দেশ ও যুগের স্বাভাবিক অবস্থা ও চাহিদা অনুসারে যুক্তিসংগত হয় এবং উপার্জনকারী কমর্চারি ও শ্রমিক তার পারিশ্রমিক দ্বারা অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ মানবিক, মৌলিক অধিকার ও জীবনধারণের অন্যান্য প্রয়োজন পূরণ করতে পারে।
শ্রমিকের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ইসলাম বদ্ধপরিকর। আর একজন শ্রমিকের সবচেয়ে বড় অধিকার বা দাবী হল, তার শ্রমের যথোপযুক্ত পারিশ্রমিক লাভ করা। এজন্য রাসূলুল্লাহ (সা.) এরশাদ করেন,
أَعْطُوا الْأَجِيْرَ أَجْرَهُ قَبْلَ أَنْ يَّجِفَّ عَرَقُه-
‘তোমরা শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও’। (ইবনু মাজাহ,মিশকাত হা/২৯৮৭)
এই হাদীস থেকে যা জানা গেলো:
১। শ্রমিকের শ্রম আটকে রাখা বৈধ নয়, কেননা এতে শ্রমিক নিজেসহ পরিবারের লোকদের নিয়ে সমস্যায়
ইসলামে মালিক- কর্মকর্তা , কমর্চারি ও শ্রমিক সম্পর্ক: ইসলামে মালিক- কর্মকর্তা, কমর্চারি ও শ্রমিক সম্পর্ক হবে পিতা-সন্তানের ন্যায়। নিজের পরম আত্মীয়ের মতোই কর্মকর্তা, কমর্চারি ও শ্রমিকের সাথে আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ করা, পরিবারের সদস্যদের মতই তাদের আপ্যায়ন করা, সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্তের প্রতি মালিকের খেয়াল রাখা এবং তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা বিবেচনা করা মালিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। তাদের প্রাপ্য পূর্ণভাবে যথাসময়ে প্রদান করাও মালিকের একটি প্রধান দায়িত্ব। ‘মহান আল্লাহ বলেন, ক্বিয়ামতের দিন তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হবে। তাদের মধ্যে একজন হল
وَ رَجُلٌ أسْتَأْجَرَ أَجِيْرًا فَاسْتَوْفَى مِنْهُ وَلَمْ يُعْطِهِ أَجْرَهُ
‘যে শ্রমিকের নিকট থেকে পূর্ণ শ্রম গ্রহণ করে অথচ তার পূর্ণ মজুরী প্রদান করে না’। (বুখারী, মিশকাত হা/২৯৮৪)
অপরদিকে একজন কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিকের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল- চুক্তি মোতাবেক মালিকের প্রদত্ত কাজ অত্যন্ত নিষ্ঠা ও বিশ্বস্ততার সাথে সম্পাদন করা। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
إِنَّ اللهَ تَعَالَى يُحِبُّ مِنَ الْعَامِلِ إِذَا عَمِلَ أَنْ يُّحْسِنَ
‘আল্লাহ ঐ কমর্চারি ও শ্রমিককে ভালবাসেন যে সুন্দরভাবে কার্য সমাধা করে’। (ছহীহুল জামে‘ হা/১৮৯১, হাদীছ হাসান)
‘তিন শ্রেণীর লোকের দ্বিগুণ পুরস্কারের কথা ঘোষণা করে বলেন,
ثَلاَثَةٌ لَهُمْ أَجْرَانِ: رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الكِتَابِ، آمَنَ بِنَبِيِّهِ وَآمَنَ بِمُحَمَّدٍ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، وَالعَبْدُ المَمْلُوكُ إِذَا أَدَّى حَقَّ اللَّهِ وَحَقَّ مَوَالِيهِ، وَرَجُلٌ كَانَتْ عِنْدَهُ أَمَةٌ فَأَدَّبَهَا فَأَحْسَنَ تَأْدِيبَهَا، وَعَلَّمَهَا فَأَحْسَنَ تَعْلِيمَهَا، ثُمَّ أَعْتَقَهَا فَتَزَوَّجَهَا فَلَهُ أَجْرَانِ “،
তাদের মধ্যে এক শ্রেণী হল – وَالْعَبْدُ الْمَمْلُوْكُ إِذَا أَدَّى حَقَّ اللهِ وَ حَقَّ مَوَالِيْهِ ‘ঐ কর্মকর্তা - কমর্চারি ও শ্রমিক যে নিজের মালিকের হক্ব আদায় করে এবং আল্লাহর হক্বও আদায় করে’। (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/১১, ‘ঈমান’ অধ্যায়)
রাসূলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, لِلْعَبْدِ الْمَمْلُوْكِ الصَّالِحِ أَجْرَانِ-‘ সৎ শ্রমিকের জন্য দু’টি প্রতিদান রয়েছে’।
আবূ হুরায়রা (রাঃ) বলেন,
وَالَّذِىْ نَفْسُ أَبِيْ هُرَيْرَةَ بِيَدِهِ لَوْلاَ الْجِهَادُ فِىْ سَبِيْلِ اللهِ وَالْحَجُّ وَبِرُّ أُمِّىْ لَأَحْبَبْتُ أَنْ أَمُوْتَ وَأَنَا مَمْلُوْكٌ
‘যেই সত্তার হাতে আবূ হুরায়রার প্রাণ তার কসম যদি আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ, হজ্জ ও আমার মায়ের প্রতি সদ্ব্যবহারের ব্যাপারগুলো না থাকত, তাহলে আমি কমর্চারি ও শ্রমিক হিসাবে মৃত্যুবরণ করতে পসন্দ করতাম’। (বুখারী হা/২৫৮৪; মুসলিম হা/৪৪১০)
পরিশেষে বলা যায়, এ সুন্দর পৃথিবীর রূপ-লাবণ্যতায় কমর্চারি ও শ্রমিক কৃতিত্বই অগ্রগণ্য। কিন্তু শত আক্ষেপ সভ্যতার কারিগর এ শ্রেণীটি সর্বদাই উপেক্ষিত, অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত। উদয়াস্ত উষ্ণ ঘামের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ নিয়ে খেটে যে শ্রমিক তার মালিকের অর্থযন্ত্রটি সচল রাখে, সেই মালিকেরই অবিচারে শ্রমিকদের অচল জীবনটি আরো দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। এটাকে সেই মৌমাছির সাথে তুলনা করা যায়, যারা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে মধু সংগ্রহ করে চাকে সঞ্চয় করে, কিন্তু তার ভাগ্যে একফোঁটা মধুও জোটে না। সুতরাং সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় মালিক-শ্রমিকের বৈরিতাপূর্ণ সম্পর্কের অবসান ঘটিয়ে ইসলামী অর্থ ব্যবস্থা ও শ্রমনীতি বাস্তবায়ন করে তাদের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন করতে হবে। আর এজন্য সর্বাগ্রে উচিত ইসলাম প্রদর্শিত মালিক-শ্রমিক নীতিমালার পূর্ণাঙ্গ অনুসরণ ও বাস্তবায়ন। মহান আল্লাহ আমাদের সহায় হৌন-আমীন ॥
ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান হিসাবে পৃথিবীর সব খেটে খাওয়া মানুষের অধিকার নিশ্চিত করেছে। শ্রমজীবী ও মেহনতি মানুষের যাবতীয় সমস্যার সঠিক, ন্যায়ানুগ, যুক্তি ও বাস্তবসম্মত সমাধান দিয়েছে। বৈধ পথে খেটে খাওয়াকে ইসলাম উৎসাহিত করেছে। বিশ্বনবি (সা.) নিজ হাতে উপার্জন করে খেতেন এবং এতেই খুব বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। তিনি বলেছেন, যারা সৎ পথে জীবিকা নির্বাহ করে তারা খোদার প্রিয় বন্ধু।
মহানবি (সা.) ছিলেন শ্রমিকবান্ধব অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব। তিনি এমন একটি সমাজব্যবস্থা কায়েমের রূপরেখা দিয়েছেন, যেখানে থাকবে না জুলুম-শোষণ কিংবা দুর্বলকে নিষ্পেষিত করার মতো ঘৃণ্য প্রবণতা। তিনি শিখিয়েছেন শ্রমিকও মানুষ, তাদেরও সম্মানের সঙ্গে বাঁচার অধিকার আছে। মানবতার মুক্তির মহাসনদ নামে খ্যাত বিদায় হজের ভাষণে তিনি বলেছেন ‘তোমাদের অধীনস্তদের প্রতি খেয়াল রাখবে। তোমরা যা খাবে তাদেরও তা খাওয়াবে, তোমরা যা পরবে তাদেরও তা পরাবে’। (মুসলিম, তিরমিজি)।